সিলেটে প্লাবিত ১ হাজার ১৭৬ গ্রাম বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

সিলেটে প্লাবিত ১ হাজার ১৭৬ গ্রাম বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

নিজস্ব প্রতিবেদক:: উজানের ঢল ও ভারী বৃষ্টিপাতে সিলেট বিভাগে তৃতীয় দফা বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।গত ২৪ ঘণ্টায় সুরমা ও কুশিয়ারাসহ সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সুরমা, কুশিয়ারা, সারি ও সারিগাঙ্গ নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।প্লাবিত হয়েছে জেলার ৯৭ ইউনিয়নের এক হাজার ১৭৬ গ্রাম। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৭ লাখ ১ হাজার ৬৫৮ জন। এছাড়া সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোণা ও শেরপুরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে সিলেট বিভাগের চার জেলার ৮৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৬ হাজার ২৭১ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে সিলেট জেলায় আট হাজার ৪০৭ জন, মৌলভীবাজারে ছয় হাজার ৬৪ জন, সুনামগঞ্জে এক হাজার ৩২৫ জন এবং হবিগঞ্জে ৪৯৩ জন।

আজ বুধবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলায় বিপৎসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে এবং সিলেট নগরীতে দুই সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।কুশিয়ারা নদীর পানি সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার অমলসীদে বিপৎসীমার ১৩৫ সেন্টিমিটার উপরে, বিয়ানীবাজার উপজেলার শেওলায় ৪৩ সেন্টিমিটার উপরে, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় ৯৯ সেন্টিমিটার উপরে এবং মৌলভীবাজারের শেরপুরে ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে উজানে বৃষ্টিপাত তুলনামূলক কম হওয়ায় সিলেটে সারি ও গোয়াইন নদীর পানি একদিনে ১০৮ সেন্টিমিটার কমে দ্রুত নেমে জৈন্তাপুর উপজেলার সারিঘাটে বিপৎসীমার ১১১ সেন্টিমিটার নিচে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।মৌলভীবাজারে মনু নদীর পানি মনু রেলওয়ে ব্রিজে বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার এবং মৌলভীবাজার সদরে ৪৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।হবিগঞ্জে খোয়াই নদীর পানি বাল্লা পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯০ সেন্টিমিটার এবং হবিগঞ্জ সদরে ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সিলেট বিভাগের চার জেলার ৮৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্রের ১৬ হাজার ২৭১ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে সিলেট জেলায় আট হাজার ৪০৭ জন, মৌলভীবাজারে ছয় হাজার ৬৪ জন, সুনামগঞ্জে এক হাজার ৩২৫ জন এবং হবিগঞ্জে ৪৯৩ জন। মানুষ ছাড়াও আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে এক হাজার ৯৬৪টি গবাদিপশু, যার মধ্যে সিলেটে এক হাজার ২০৩টি, মৌলভীবাজারে ৫৪৭টি, সুনামগঞ্জে ১২৩টি ও হবিগঞ্জে ৯১টি।

সিলেট ও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম থাকায় নিম্নাঞ্চল এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। তবে ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর, এতে আবারও পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। নতুন করে বৃষ্টিপাত না হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে কিছু এলাকায় এখন বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে। অনেক জায়গায় ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরে পানি প্রবেশ করেছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা।  
কোম্পানীগঞ্জ থানা সদরের বাসিন্দা মঈন উদ্দিন জানান, মঙ্গলবার থেকে পানি কমতে শুরু করেছে, এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরছে। তবে বৃষ্টি হলেই মনে আতঙ্ক কাজ করে। কখন যে ঘরের ভেতরে পানি প্রবেশ করে এ চিন্তায়।
গোয়াইনঘাট উপজেলার বিছানাকান্দি ইউনিয়নের বাসিন্দা নজির মিয়া জানান, নিম্ন এলাকা থেকে পানি নামছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা আব্দুস সত্তার জানান, নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে এতে করে আবারও ঘরের ভেতরে পানি প্রবেশ করেছে। ঘরের আসবাবপত্র পানিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কিছু জিনিস ওপরে তুলে রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় চরম বিপাকে পড়েছেন বলে জানান তিনি। 
জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত সিলেট মহানগর ও ১৩টি উপজেলায় ১ হাজার ১৭৬টি গ্রাম প্লাবিত ছিল। বন্যায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৭ লাখ ১ হাজার ৬৫৮। ১৮৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো ৮ হাজার ৩৫১ জন মানুষ অবস্থান করছেন।
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন জানান, সিলেটে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৫ মিলিমিটার বৃ‌ষ্টি হয়েছে। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় সিলেটে ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হতে পারে।
ভারতের আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানান, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি সবকটি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপরে অবস্থান করছেন। বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকলে নদ-নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পাবে।
তিনি জানান, বুধবার দুপুর ১২টার তথ্য অনুযায়ী সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই পয়েন্টে পানির বিপদসীমা ১২ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। নদীর সিলেট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই পয়েন্টে পানির বিপদসীমা ১০ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার। আমলশীদ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই পয়েন্টে পানির বিপদসীমা ১৫ দশমিক ৪০ সেন্টিমিটার। শেওলা পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই পয়েন্টে পানির বিপদসীমা ১৩ দশমিক ০৫ সেন্টিমিটার। ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৯৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই পয়েন্টে পানির বিপদসীমা ৯ দশমিক ৪৫ সেন্টিমিটার। তা ছাড়া লুবা, সারি, সারিগোয়াইন, ডাউকি, ধলাই নদীর পানি বিপদসীমার নিচে অবস্থান করছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে, আমাদেরও সেভাবে প্রস্তুতি রয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালিক রুমাইয়া জানান, উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। নতুন করে বৃষ্টিপাত না হলে আরও উন্নতি হবে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, জেলায় অব্যাহত ভারী বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের ফলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে প্রশাসন আগে থেকেই সতর্ক অবস্থানে ছিল। যারা পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন তাদেরকে উদ্ধারে প্রশাসন কাজ করছে। আশ্রয়কেন্দ্র ও পানি বন্দিদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ চলমান রয়েছে। তাছাড়া বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য উপজেলা পর্যায়ে ডেডিকেটেড কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন ভিত্তিক ট্যাগ কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে।
সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার আবু আহমদ ছিদ্দীকী বলেন, ‘চলমান বন্যা পরিস্থিতির মধ্যেই নতুন করে অতিবৃষ্টির ফলে আবারও বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ায় জনদুর্ভোগ বাড়ছে। প্রশাসন জনদুর্ভোগ লাঘবে আক্রান্ত প্রতিটি পরিবারের কাছে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করছে।’
সিলেট বিভাগে চলতি বন্যা পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত চার হাজার ২৩৫ টন চাল, এক কোটি ১৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা নগদ, ২৯ হাজার ৮৩০ প্যাকেট শুকনো খাবার, ৪০ লাখ টাকার শিশু খাদ্য এবং ৪০ লাখ টাকার গোখাদ্য ত্রাণ হিসেবে বরাদ্দ পাওয়া গেছে, যা পর্যায়ক্রমে বিতরণ চলছে বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার।
নতুন করে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা আরও ত্রাণ সহায়তা চেয়েছি মন্ত্রণালয়ের কাছে। বন্যা শেষে ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথভাবে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হবে  বলেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *